ফাইল ছবি
নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই উৎসব আজ। প্রথম থেকে নবম শ্রেণির তিন কোটি ৮১ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হবে নতুন বই। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আগের শিক্ষাক্রমের বই পাবে। বাকি সাত শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পাবে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী লেখা বই। নতুন পাণ্ডুলিপির বইগুলোতে ভুল ও ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে শঙ্কা থাকলেও দ্রুত সমাধানে সজাগ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তবে কাগজের মান নিয়ে কিছুটা আতঙ্কে সংস্থাটি।সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার ভুল-ত্রুটির সমালোচনা ভালো চোখে দেখার মনোভাব নিয়ে কিছুটা আগাম প্রস্তুতি নিয়েছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বই নতুন করে লেখা, সময়ও পাওয়া গেছে কম। ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। সেগুলো উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণসহ ধরিয়ে দিলে সংশোধনী দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নিয়ে রিভিউ কমিটি করার কাজও এগিয়ে রেখেছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান।পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। এ দুই শ্রেণির ২২টি পাঠ্যবইয়ে নানান ভুল, অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছিল। শিক্ষার্থীদের হাতে বই যাওয়ার পর এগুলো সামনে আসে। ওই সময় এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ভুল সংশোধনে রিভিউ কমিটি করে এনসিটিবি। ওই কমিটির সদস্যরা চারমাস কাজ করে ২২ বইয়ে ৪২১টি ভুল পায়। সেগুলোর সংশোধনী স্কুলে স্কুলে ফটোকপি করে পাঠানো হয়।অনেকে পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বই বিতরণের পরই দেখবেন—সব সামনে আনবেন তারা। তবে এগুলো আমরা সাদরে গ্রহণ করবো। এতগুলো বই নতুন পাণ্ডুলিপির মাধ্যমে আমরা এবার ছাপাচ্ছি, ভুল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তথ্যগত অনেক ভুল, পাঠ্যের ভুল থাকতে পারে। আমরা ভুলগুলো রিভিউ করে দ্রুত সংশোধনী দেবো।-এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলামশিক্ষকরা জানান, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের বইয়ে ভুল থাকায় চারমাস অনেক অধ্যায় শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারেননি। সংশোধনী দিতে দেরি করায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্লাস শেষ করতেও হিমশিম খেয়েছেন তারা। এবার যদি ভুল থাকে, সেটা যেন এক-দেড় মাসের মধ্যেই সংশোধনের উদ্যোগ নেয় এনসিটিবি।কঠোর গোপনীয়তার মধ্যেও ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে ফাঁস হয়। অনেকে নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে থাকা ভুল নিয়ে সমালোচনাও শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট দেন। তবে ‘অপপ্রচার ও গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে এনসিটিবি বাধ্য হয়ে মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় শিক্ষক-অভিভাবকসহ চারজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর থেকে পাঠ্যবই নিয়ে কার্যত সমালোচনা বন্ধ। তবে নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়ার পর ভুল-ত্রুটি নিয়ে যে কেউ কথা বলার সুযোগ পাবেন।ভুল-ত্রুটি ধরাকে ইতিবাচকভাবে দেখবেন বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অনেকে পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বই বিতরণের পরই দেখবেন—সব সামনে আনবেন তারা। তবে এগুলো আমরা সাদরে গ্রহণ করবো। এতগুলো বই নতুন পাণ্ডুলিপির মাধ্যমে আমরা এবার ছাপাচ্ছি, ভুল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তথ্যগত অনেক ভুল, পাঠ্যের ভুল থাকতে পারে। আমরা ভুলগুলো রিভিউ করে দ্রুত সংশোধনী দেবো।’অধ্যাপক ফরহাদুল বলেন, ‘এবার আমরা দ্রুত রিভিউ কমিটি করবো। ভুলগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে সংশোধনীর ব্যবস্থা নেবো। শিক্ষার্থীদের ক্লাস বা শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকেও নজর রাখা হবে।’এনসিটিবির শিক্ষাক্রম ইউনিটের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া আর গুজব-অপপ্রচার এক বিষয় নয়। আমরা বলবো—আপনারা যৌক্তিক সমালোচনা করুন, ত্রুটিও ধরিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা এমনভাবে নয় যা গুজব ও অপপ্রচারকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়।
’নিম্নমানের কাগজ নিয়ে ‘বিড়ম্বনা’
ভুল-ত্রুটির চেয়েও এনসিটিবিকে এবার নিম্নমানের কাগজে ছাপা বই নিয়ে বেশি লজ্জায় পড়তে হতে পারে। এবার দ্রুত বই ছাপা শেষ করতে গিয়ে কাগজের মানে নজর দিতে পারেনি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। ছাপাখানাগুলোতে নিয়মিত তদারকি ও নজরদারির কমতিও ছিল। ইন্সপেকশন অফিসাররাও ছাপাখানার সঙ্গে যোগসাজশ করে সঠিক তথ্য দেননি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। খোদ এনসিটিবির কর্মকর্তারাই এসব কথা জানান।পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা বই ডেলিভারি নেওয়ার সময় যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি দেখে নেওয়ার। এরপরও কিছু অসঙ্গতি থেকে গেছে। ইন্সপেকশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ পেয়েছি। তাদের নোটিশ করা হয়েছে। অনেকগুলো ছাপাখানায় গিয়ে আমরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার প্রমাণ পেয়ে সেসব বই কেটেও ফেলেছি। আমাদের জায়গা থেকে চেষ্টার কোনো কমতি রাখিনি।’আমরা বই ডেলিভারি নেওয়ার সময় যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি দেখে নেওয়ার। এরপরও কিছু অসঙ্গতি থেকে গেছে। ইন্সপেকশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ পেয়েছি। তাদের নোটিশ করা হয়েছে। অনেকগুলো ছাপাখানায় গিয়ে আমরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার প্রমাণ পেয়ে সেসব বই কেটেও ফেলেছি। আমাদের জায়গা থেকে চেষ্টার কোনো কমতি রাখিনি।- পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমানএনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘ছাপাখানার ওরা তো সুযোগ খোঁজে। কতক্ষণ আপনি তাদের পাহারা দিয়ে কাজ করাবেন? ভালো কাজের জন্য সবার সমন্বয় দরকার। ছাপাখানার মালিকরা তো আমাদেরই অংশীজন। তারা যদি সব সময় ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বই ছাপেন, তাহলে তো মুশকিল। কেমন বই তারা দিয়েছেন, তা তো সব খুলে দেখা সম্ভবও নয়। বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তায় রয়েছি।’পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা ধরা হয়েছে তিন কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ জন। তাদের জন্য বই ছাপানো হয়েছে মোট ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি। প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো হয়েছে ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৪২৩ কপি বই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই সংখ্যা ৩ কোটি ৩৬ লাখ ১ হাজার ২৭৪টি। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৬১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৮ কপি বই ছাপা হয়েছে।ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছয় কোটি ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩০৮ কপি, সপ্তম শ্রেণির চার কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার কপি, অষ্টম শ্রেণির জন্য পাঁচ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ২৭১ কপি এবং নবম শ্রেণির জন্য পাঁচ কোটি ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৩ কপি বই ছাপা হচ্ছে।অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (পাঁচটি ভাষায় রচিত) শিশুদের জন্য এবার মোট দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩১ কপি বই ছাপা হচ্ছে। অন্য বইয়ের মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৫২ কপি ‘ব্রেইল’ বই ছাপা হবে। তাছাড়া শিক্ষকদের ‘শিক্ষক সহায়িকা’ দেওয়া হবে ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৮টি।