
আন্তর্জাতিক ডেক্স :
আজ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মৌলিক অধিকারে এমনকি সমতার দাবিতে লড়তে হচ্ছে আজ এই নারীদের। তবে সেই লড়াই সবখানে একরকম নয়। যেমন- দক্ষিণ এশিয়ারই দুই দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নারী অধিকারের ব্যবধান রীতিমতো আকাশ-পাতাল। এই দুই দেশে নারী অধিকার পরিস্থিতির একটি তুলনা মূলক চিত্র ফুটে উঠেছে আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিটিক্যাল অ্যান্ড ফরেন অ্যাফেয়ার্সের (সিপিএফএ) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ফাবিয়ঁ বোসার্তের একটি কলামে।
বৃহস্পতিবার ইউরোপভিত্তিক মতামত বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম মডার্ন ডিপ্লোম্যাসিতে প্রকাশ হয়েছে তার লেখাটি। ফরাসি এই বিশ্লেষক বলেছেন, পাকিস্তানে বহু বছর ধরেই নারীরা বৈষম্যের শিকার।অন্যথায়, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ নারীদের জীবনমান উন্নয়নে অসাধারণ উন্নতি করেছে। মাতৃ মৃত্যুহার কমছে, জন্মহার নিম্মমুখী, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও চমৎকার লিঙ্গভিত্তিক ভারসাম্য দেখা যায়। নারীদের প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিয়ের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। দেশটির বৃহত্তম রফতানিকারক শিল্প তৈরি পোশাক খাতে ৩০ লক্ষাধিক নারী কাজ করছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাতেও তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাকিস্তানে নারীদের মৌলিক অধিকার হরণ পাকিস্তানে নারীদের বর্তমান আইনি অবস্থান রূপায়িত হয়েছিল মূলত জিয়া-উল-হকের সামরিক শাসনামলে।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সালের সেই সময়টিতে একাধিক দমনমূলক আইন পাস হয়, যাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে নারীদের প্রতি বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এসকল আইনের মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হয়ে ওঠার পূর্বপ্রতিশ্রুতি থেকে অনেকটা দূরে সরে যায় পাকিস্তান। সেখানে হুদুদ অধ্যাদেশ জারি হয়, যাতে পারিবারিক আইন এবং যৌনতা বিষয় ‘ইসলামী আইনের’ বেশ কিছু রক্ষণশীল নীতি ব্যবহার করা হয়।
তবে ধর্ষণ, ‘অনার কিলিং’ (পারিবারিক সম্মান রক্ষার অজুহাতে হত্যা), অ্যাসিড নিক্ষেপ, পারিবারিক সহিংসতা, জোরপূর্বক বিয়ের মতো বিষয়গুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৯ ইং সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, পাকিস্তানে প্রতিবছর অন্তত এক হাজার অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে।
তবে এর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা।নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে প্রাণঘাতী হামলার পর খবর বেরিয়েছিল, হামলাকারী ওই ঘটনার আগে পাকিস্তান গিয়েছিলেন। এ নিয়ে সিএনএনের একটি প্রতিবেদন টুইটারে শেয়ারের পরপরই ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন গারিদাহ ফারুকি।
তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচারের দাবি তোলা হয়েছিল। বালোচিস্তান নিয়ে প্রতিবেদন করায় প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন সাবিন আগা নামে আরেক সাংবাদিক। ওই প্রতিবেদনের পর থেকেই তার ওপর নজর রাখছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। পাকিস্তানে নারীদের পদযাত্রা পাকিস্তানের নারীরা সমাজে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে বেছে নিয়েছেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি গুলোর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ৮ মার্চ প্রথমবার রাস্তায় নামেন পাকিস্তানি নারীরা।
এরপর থেকে প্রতিবছরই এ দিনটিতে দলে দলে পদযাত্রায় সামিল হন তারা, কখনো আয়োজন করেন সচেনতামূলক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। তবে লজ্জার বিষয়, প্রায় প্রতি বছরই নারীদের এই পদযাত্রায় ইট-পাথর, জুতা, লাঠিসোটা নিক্ষেপ করে পাকিস্তানের মৌলবাদীরা। বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলন এই বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তানের নারীরা যখন রাজপথে, তখন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ট্রান্সজেন্ডার (রূপান্তরিত) নারী হিসেবে টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ শুরু করেন তাসনুভা আনান শিশির। এটি যেন বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের বৈচিত্র্যময় এবং প্রাণবন্ত প্রকৃতিরই প্রতিরূপ।
বাংলাদেশে নারী অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা ও সমাজকর্মীরা নানা ধরনের সামাজিক কর্মসূচি আয়োজন করে এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে তাদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছেন। সন্দেহাতীত ভাবে, বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলনকর্মীরা লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুবিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছেন।
পরিবর্তনের এই দাবি বাংলাদেশের রাজনীতির চেহারাও পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশে নারী অধিকারের অগ্রগতি ১৯৭১ ইং সালে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে বাংলাদেশ। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ১৯৪৭ ইং সাল থেকে এদেশের নারীরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন। ১৯৯১ ইং সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যে নতুন সংবিধান হয়েছে, সেখানে সব ক্ষেত্রেই নারীদের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিধবা ভাতা বাড়িয়েছে, কৃষি ও ইলেক্ট্রনিকসের মতো খাতগুলোতে নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
২০১১ ইং সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে নারী-পুরুষ সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা দেয়ার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এসব উন্নয়ন নীতি ঠিকভাবে কাজ করছে কি না তা তদারকিতে ৫০ জন সদস্যের জাতীয় নারী ও শিশু উন্নয়ন কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজেও জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চগুলোতে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের সমাজ আজ রাজনৈতিক ও নাগরিক কার্যক্রমগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ সমর্থন করে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নারী উদ্যোক্তাদের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার ঋণ কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়েছে।
অন্য খাতেও নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে উচ্চশিক্ষিত নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ ইং সালে পারিবারিক সহিংসতা আইন পাস করে বাংলাদেশ।
এরপর থেকেই সেখানে নারীদের প্রতি সহিংসতার হার দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে।