Subscribe our Channel

এমপিকে হত্যা করতে ফয়সাল – মোস্তাফিজুরের পাসপোর্ট করা হয় এপ্রিলে

নিজস্ব  প্রতিবেদক : ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় গত দুই থেকে তিন মাস আগে। তবে হত্যার ছক আঁকা হয় হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে। হত্যায় সরাসরি কারা, কবে ও কীভাবে অংশ নেবে সবকিছু পরিকল্পনা করেই মাঠে নামে হত্যাকারীরা।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে জড়িত তিনজনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছে। তবে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী এমপিরই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আক্তারুজ্জামান শাহীন এখনও অধরা। এছাড়া হত্যায় অংশ নেওয়া আরও কয়েকজনও রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমপি খুনের ঘটনা প্রকাশের পর গাঁ ঢাকা দিয়েছেন জড়িতরা।তদন্তকারী সংস্থা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য বলছে, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানুল্লাহ আমান, মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। নাম উঠে আসছে শাহীনের আরও দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদের। জড়িট শাহীনের বান্ধবী সিলিস্তি রহমানও।গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, ফয়সাল ও মোস্তাফিজুরের দুটি পাসপোর্টই চলতি বছরের ৮ এপ্রিল ঢাকার বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে ইস্যু করা হয়েছে। পাসপোর্টে ফয়সালের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে খুলনার ফুলতলা থানার অলকা গ্রাম এবং মোস্তাফিজুরের স্থায়ী ঠিকানা খুলনার ফুলতলার যুগনীপাশা গ্রাম উল্লেখ করা হয়েছে। আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়।তবে দুজনেরই বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকার ক-৩২/১২ নদ্দা।গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এমপি আনারকে কলকাতায় হত্যার পরিকল্পনা সাজিয়েই মোস্তাফিজ ও ফয়সালের পাসপোর্ট করানো হয়। ভারতীয় ভিসা সংগ্রহ করে ১১ মে কলকাতায় প্রবেশ করেন তারা। হত্যাকাণ্ড শেষে ১৭ মে মোস্তাফিজ ও ১৮ মে ফয়সাল দেশে ফিরে আসে।

মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে ধরতে অভিযান

এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সিয়াম নামে এক যুবককে গ্রেফতারের তথ্য জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত অপর তিন যুবক জিহাদ ওরফে জাহিদ, ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, সিয়ামের সঙ্গে জিহাদও কলকাতাতেই আত্মগোপন করতে পারে। তবে ফয়সাল ও মোস্তাফিজ দেশে ফিরেছেন। দেশে ফেরার পর তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

দুই মাস আগে যেভাবে পরিকল্পনা

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, এমপি আনারের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুই মাস আগেই হত্যার পরিকল্পনা করেন ব্যবসায়িক অংশীদার আক্তারুজ্জামান শাহীন। ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরা এলাকার পৃথক দুটি বাসাতে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন শাহীন। এমপি আনার যেহেতু ঘন ঘন ভারতে যাতায়াত করেন এজন্য ভারতেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া তার সহযোগী মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও ফয়সাল আলী সাজিকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তার বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের পরিকল্পনায় হত্যার কাজটি করেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া।

শাহীনের সঙ্গে ২০০ কোটি টাকার দ্বন্দ্ব ছিল এমপি আনারের 

আনারকে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ২০০ কোটি টাকার লেনদেনের বিরোধ ছিল বলে জানা গেছে। এমপি আনারের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যবসা করতেন হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীন এই ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। আর এমপি আনোয়ারুল আজীম সেই অর্থ দিয়ে দুবাই থেকে বিশেষ কৌশলে ও অবৈধভাবে স্বর্ণের বার এনে ভারতে পাচার করতেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, ছোটবেলার বন্ধু হিসেবে আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে আগে যৌথভাবে স্বর্ণ চোরাকারবারির ব্যবসা করলেও এমপি আনোয়ারুল আজীম সম্প্রতি ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব আগের মতোই ছিল।

হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় স্তব্ধ গোয়েন্দারাও

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এমপি আনারকে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে তারা নিজেরাই আঁতকে উঠেছেন। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, তিনি তার পুলিশি ক্যারিয়ারে অনেক খুনের ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন, কিন্তু এত নৃশংস বর্ণনা কখনোই শোনেননি।জিজ্ঞাসাবাদে আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া জানিয়েছে, কীভাবে এমপি আনারকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর হাত-পাসহ শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলাদা করা হয়। যেন কোনোভাবেই এমপি আনারের চেহারা দেখে কেউ পরিচয় শনাক্ত করতে না পারে।

ভারতীয় পুলিশ যা জানতে চেয়েছে ডিবির কাছে

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যার তদন্তে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও বাংলাদেশের পুলিশ সমন্বয় করে তদন্ত করছে। ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) চার সদস্যের একটি দল বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বাংলাদেশে আসে। তারা সন্ধ্যার পর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে ঢাকায় গ্রেফতার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয় বাংলাদেশি ডিবি ও ভারতীয় পুলিশের মধ্যে। এরমধ্যে গ্রেফতারদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ভারতীয় পুলিশ।ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভারতীয় পুলিশের যে দল ডিবিতে এসেছেন তারা ডিবির হাতে গ্রেফতার আসামিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ডিবির কাছে যে তথ্যগুলো গ্রেফতার আসামিরা জানিয়েছিলেন তারা ভারতীয় পুলিশের কাছে একই তথ্য স্বীকার করেছেন।

ভারত যাবে বাংলাদেশের ডিবি দলও

আগামী সপ্তাহের শুরুতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওয়ারী বিভাগের একটি দল কলকাতায় যাবে। কলকাতা পুলিশের হাতে সিয়ামসহ যারা গ্রেফতার রয়েছেন তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ডিবির টিম। ভিসা প্রসেসিং সম্পন্ন হলে ডিবির কর্মকর্তারা ভারতে যাবে এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে। এছাড়া এমপি আনার কলকাতায় যে বাসায় উঠেছিলেন সেই গোপাল বিশ্বাসকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে বাংলাদেশের ডিবির টিম।জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন রর রশীদ বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যত বড় শক্তিই জড়িত থাকুক তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে আমরা এক নারীসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছি। আরও কয়েকজন দেশের মধ্যে পালিয়ে আছেন। তাদের ধরতে ডিবির একাধিক দল মাঠে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। এছাড়া ভারতীয় পুলিশও হত্যার সঙ্গে জড়িদের গ্রেফতার করেছে।তিনি বলেন, ঢাকার গুলশান ও ধানমন্ডির দুটি বাসায় এক-দুই মাস ধরে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার পরিকল্পনা হয়।  ঢাকায় ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকায় হত্যার স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় কলকাতাকে। খুনের পর হত্যাকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। কী কারণে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে সেটি বের করা হবে। তবে এখন মূল কাজ হলো, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বের করা। এজন্য কলকাতা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একসঙ্গে কাজ করছে।মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ আরও বলেন, এমপি আনারকে হত্যার পর লাশটি গুম করতে শরীর টুকরা টুকরা করে হাড্ডি ও মাংস আলাদা করা হয়। এরপর কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে, এজন্য হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ওই বাসা থেকে বের করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় মরদেহের খণ্ডিত অংশ ফেলা হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।আনোয়ারুল আজীমের পুরো লাশ না পাওয়া গেলেও খণ্ডিত মরদেহ পাওয়া যাবে বলে মনে করেন এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *