মোঃ তোতা মিয়া বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান রংপুর :
পঞ্চগড় তেতুলিয়া উপজেলা সদরের পুরাতন বাজার পর্যন্ত আঁকাবাঁকা পথে প্রায় ৪০ কিলোমিটার প্রবাহিত নদীটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখা চিহ্নিত করে আবার ভারতে প্রবেশ করেছে। উইলিয়ম হান্ডারীর জরিপে(১৮৭৬) থেকে জানা যায় মহানন্দা এক সময় একটি প্রশান্ত এবং গভীরতা নদী ছিল, যার বুকে চলাচল করত বড় বড় মালবাহী নৌকা। মহানন্দা নদীর সীমান্তের এপারে বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা আর অন্যপাশে ভারতের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি ও চটের হাট থানা। এই মহানন্দা নদী যেন বাংলাদেশ ভারত মানচিত্র কে দ্বিখন্ডিত করেছে। মহানন্দা নদীর জলরাশিতে ভোরবেলা যখন সূর্যের লাল রশ্নি ঝলমল করে সোনালী আলোর ঝিলিক পরে। তখন জেলেদের নেই ট্রাক্টরের টিউব, নেট, কোদাল আর আলু কাটার যন্ত্র নিয়ে হাজারো শ্রমিক দিগদিগ্নতক ছুটে চলে মহানন্দা নুড়িপাথর সংগ্রহে। আশির দশকের আরো আগে থেকে মহানন্দা নদীতে শ্রমিকদের পূর্বপুরুষদের ন্যায় পাথর সংগ্রহ করলেও নুড়ি পাথরের কোন কমতি নেই এ যেন আল্লাহ পদার্থ তাদের রিজিকের জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সেই সময় মহানন্দা নদীতে পাহাড়ি পানির ঢলের খর স্রোতে খুব বেশি ছিল। কিন্তু পাথর শ্রমিকের সংখ্যা খুব কম ছিল। তখন শ্রমিকরা মহানন্দা নদীতে ৫/৬ টি কলাগাছের ভেলা তৈরি ঢাকি কোদাল আর নেট নিয়ে সাঁতরিয়ে নদীর বালুচর ঘেঁষে পাথর সংগ্রহ করত। প্রায় ঘণ্টা চারেক পর উক্ত ভেলায় ৮/১০ টি ঢাঁকি বোঝাই পাথর নিয়ে ঘাটে ফিরে আসত। অবশ্য সে সময় নদীর পানি আর স্রোত বেশি হওয়ায় অনেক সময় পানির স্রোতে ভেলা উল্টে সবকিছু ভেসে শ্রমিকদের সর্বনাশ হত। আর এমন অবস্থায় পড়লে শ্রমিকদের সেই দিনে রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যেত। তখন পুনরায় নতুন করে পাথর তোলার সামগ্রী কিনে নদীতে যেতে হতো। মহানন্দা একটি আন্তঃ সীমান্ত নদী হওয়া সত্ত্বেও ৯০ দশকের পর ভারতের ফুলবাড়ী নামক স্থানে একতরফা বাঁধ নির্মাণ করে মহানন্দা নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন করে। ফলে মহানন্দা নদীর খোরস্রোত অনেকটাই কমে যায়। নদীর বুকে জেগে উঠা ধুধু বালুচর।
তখন থেকে মহানন্দায় পাথর শ্রমিকদের ভেলা আশার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ভারতের বিএসএফ পাথর তোলার বাধা দেয় এবং বিএসএফর বাধা উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে নদীতে পাথর তুলতে গিয়ে ঝাড়ুয়া পাড়া, ও দক্ষিণ উত্তর কাশেমগঞ্জ গ্রামের বেশ বেশ ক’জন পাথর শ্রমিক বিএসএফের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তখন মাঝে মধ্যে মহানন্দা নদীতে পাথরতলা বন্ধ থাকতো। এ নিয়ে দু’দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পতাকা বৈঠক এসব বিরোধ নিষ্পত্তি করতো এবং মহানন্দা নদীতে পাথর তোলার ব্যবস্থা করতো। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করার পরেও পাথর শ্রমিকদের ভারত শ্রমিকদের উপর সীমান্ত বাহিনীর নির্যাতন চালাত। বর্তমানে মহানন্দা নদীতে বর্ষাকালে গাড়ির টিউব নদীর পানিতে ভাসিয়ে ও শুকনো মৌসুমে শ্রমিকরা দুটি ঢাকির ভার সাজিয়ে বালুরচর বেয়ে পাথর সংগ্রহ করত। এখনো পাথর সংগ্রহ এই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। সদ্দার পাড়া গ্রামের পাথর শ্রমিক বলেন মহানন্দা নদীর পাথর তুলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো তারি পরম্পরা তাই আমরাও পাড়ি জমিয়েছি।
বর্তমানে আমরাও এই নদীতে তোর তোলে পরিবার পরিজন নিয়ে যুগের পর যুগ পাথর তুলে আসতেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনার ফাঁকে নদীতে পাথর তোলার কাজ করে। বর্তমানে তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকায় গরিব দুঃখী লোকজন এই এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে নদীতে পাথর তোলার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। শ্রমিকরা জানায় ভারতের বিএসএফ এখন পাথর তুলতে বাধা দেয় না। বরং তাদের অফিসার আসলে বলে হিন্দি ভাষায় গিল্টি তোলা মত করো ওপার মে ভাগ যাও আমরা তখন নিরাপদে চলে আসি। ভারতের অফিসার চলে গেলে পুনরায় পাথর সংগ্রহ করে থাকি। শ্রমিকরা আরও জানান মহানন্দা নদীর কারণে ঠান্ডা পানিতে পাথর তোলার কারণে তাদের শরীরে চর্মরোগ এলার্জি বাত ব্যথা ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে। বাজারে পল্লী চিকিৎসক দের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে পুনরায় নদীতে কাজ করি। এভাবেই তাদের জীবন ও জীবিকা মহানন্দা নদীর পাথর তুলে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। পাথর ব্যবসায়ী রা জানান, একজন শ্রমিক দিনে ৫/৬ ঘন্টা পাথর সংগ্রহ করলে আটশত থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে। শ্রমিকদের প্রতি ঘনফুট (এক সেফটি) পাথর বর্তমানে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে কেনা হয়। আমরা তখন নেটিং করে ছাটাই বাছাই ও শুটিং করে প্রতি সেফটি পাথর ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করি। তবে শ্রমিক ছাড়াও ট্রাক মালিক চালক ব্যবসায়ী পাথরের উপর নির্ভর করে জীবন-জীবিকা চালিয়ে বেকারত্ব জীবন থেকে রেহাই পাচ্ছি। এই পাথর উত্তোলন করতে না পারলে এই এলাকায় ভিশন দুর্ভোগের কবলে করতো মানুষ শিক্ষা দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে পড়তো এলাকার মানুষ তাই নুড়িপাথর এই এলাকার মানুষের জীবন।