Subscribe our Channel

মুক্তিযুদ্ধের স্বচক্ষে দেখা কিছু কথা বলতে চাই
লেখক মোঃ তোতা মিয়া পঞ্চগড় :
মুক্তিযুদ্ধ স্বচক্ষে দেখা তখন আমার বয়স ৮ বছর হবে, তখন আমার বাবা পঞ্চগড়ের বিশিষ্ট হোটেল ব্যবসায়ী ছিলেন। পঞ্চগড় বাজারে আমার বাবার একমাত্র হোটেল ছিল তখনকার যুগে নামকরা। আমাদের জন্মস্থান বাসা ছিল ইসলামবাগ লেখাপড়া শুরু হয় ডকোরো পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। তখন আমাদের বাড়ির আশেপাশে অনেক পশ্চিমা বিহারী বাস করতেন। তখনকার সময়ে ভালোই চলছিল আমাদের সংসার। তবে পাকিস্তানী শাসকদের অত্যাচার ছিল খুব বেশী ঠিকমতো কথা বলা যাচ্ছিল না পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। ওরা দোষ করল মাথা নত করে থাকতে হতো আমাদের, ওই সময় বাবা মা  মুখে শুনেছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ১৯৭১ সাল মায়ের মুখে শুনতাম কি যেন একটা গন্ডগোল লেগেছে ঢাকায়। তখন ততটুকু বুঝতে পারতাম না, সারাদিন দোকান শেষে বাবা এসে রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে মায়ের সঙ্গে গল্প করছিল দেশে এবার যুদ্ধ লাগতে পারে। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল এখন তাহলে কি হবে, বাবা বলে উঠলো কি আর হবে পশ্চিমাদের কাছ থেকে দেশ স্বাধীন করতে হবে। মা বলল যুদ্ধ লাগলে তো অনেক মানুষ মরবে আমরা তখন কোথায় যাব কি খাব। বাবা বললেন দেশের মানুষের যা হবে আমাদেরও তাই হবে। এবিসয়ে পাকিস্তানিদের সাথে  চলতে থাকে দুই পক্ষের মধ্যে নানা কথা পাকিস্তানি কায়েদে আজম জিন্নাহ খান যাচ্ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু। আর বাংলার মানুষের দাবি ছিল পূর্বপাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে বাংলা। এই নিয়ে নাকি ঢাকায় তুমুল সংগ্রাম চলছিল ওই সময়ে। এভাবে কথা চলতে চলতে এক সময় যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হলো বাবার রেডিওতে সন্ধ্যা হলেই বিবিসি লন্ডন থেকে খবর শোনার জন্য আমাদের বাড়িতে ভিড় জমাতো মানুষ। হঠাৎ করে শুনতে পারলাম মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা যারা আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা। আস্তে আস্তে অনেক মানুষ ভয়ে বাড়ি ঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করলো আমার অনেক বন্ধুরাও গ্রাম অঞ্চলের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় পালিয়ে গেল। ওই মুহূর্তে মানুষের পেটে ভাত যেত না যুদ্ধের চিন্তায় মানুষকে কোথায় পালাবে সেই চিন্তা নিয়েব্যস্ত ছিল।  বিভিন্ন স্থানে শুরু হলো মুক্তিবাহিনীর ট্রেডিং। বাবা আমাদেরকে মামার বাড়ি শালশিরী গ্রামে রেখে আসলো। বাবা একাই সন্ধ্যা পর্যন্ত পঞ্চগড় শহরে থাকতো মা পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো বাবা কখন আসবে। এরইমধ্যে পাকিস্তানি মিলিটারিরা পঞ্চগড়ের এলাকায় ঢুকে বিভিন্ন স্থানে ব্যাংকার তৈরি করতে শুরু করল তারমানে যুদ্ধ অনিবার্য। তখন আমাদের দেশের দামাল ছেলেরা বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং শেষে তারাও প্রস্তুতি রেডি যুদ্ধে নামার জন্য। হঠাৎ একদিন রাতের বেলায় বিকট শব্দে গোলাগুলি শুরু হয় ওই মুহূর্তে হতাহতের কথা মনে নেই তবে অনেক মায়ের কোল খালি হয়েছে। তবুও বাঙালি পিছুপা হয় নাই, এভাবে চলতে থাকে টুকটাক করে যুদ্ধ। এদিকে বাবা বাড়ির আঙিনায় একটি ব্যাংকার তৈরি পড়েছেন এবং বাবা আমাদেরকে ডেকে এনে কিভাবে ব্যাংকারে  থাকতে হবে তা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা আবার মামার বাড়ি চলে গেলাম। মামার বাড়ি থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম পঞ্চগড়ের অনেক মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে হানাদার বাহিনীরা। লুটপাট করছে হানাদার বাহিনীর দোসোরেরা, এমনকি মা-বোনদের উপর চালাচ্ছেন নির্মম অত্যাচার। এভাবে দু মাস চলার পর পরিবেশ কিছুটা শান্ত হল। এ বিষয়ে নাকি আলোচনায় বসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে, কায়েদে আজম জিন্নাহ খান। কিন্তু আলাপে সংশোধন হলো না। আমরা তখন ফিরে এলাম আমাদের জন্মভূমি ইসলামবাগ এর বাড়িতে। আমি তখন বাড়ির আঙিনায় আমার এক বন্ধু সহ খেলছিলাম মা রান্নাঘরে কি যেন রান্না করছিল। তখন বর্ষার দিন চারিদিকে পানি। হঠাৎ আমাদের বাড়ির  উত্তর দিক থেকে  দলবেঁধে একটি বিমান এসে পঞ্চগড় শহরটাকে তছনছ করে দিলো বোমা ফেলে। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হলো মানুষের আহাজারি আর লাশের মিছিল বাজার থেকে একে একে লাশ আসতে শুরু করল আমাদের বাড়ির সামনের তে পথিতে। সকালে যার সঙ্গে কথা বলেছিলাম সে আমার বাড়ির সামনে লাশ হয়ে পড়ে রয়েছে। তখনকার সময়ে মানুষ এমনিতেই একটু ভীতু ছিল। লাশ দাফন করার মানুষ পাওয়া যেত না। কোনরকম লাশগুলোকে দাফন করে শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করল মানুষ। আমরাও পালিয়ে গেলাম বাড়িঘর ফেলে রেখে। পালিয়ে যাওয়ার দুদিন পর আবারো পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় আমাদেরকে নিঃসঙ্গ করে দিয়ে দিয়েছে আমরা তখন পথের ফকির কি খাব কোথায় যাব কিছুই করার ছিলনা। বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে লুটপাট হয়েছে বাড়ির মান সমান। বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কর্ম মানুষের। শুধু হাহাকার আর হাহাকার মানুষের মধ্যে। কোন মানুষের বাড়িতে খাবার নেই গ্রামের মা চাচীরা আমাদের কষ্ট দেখে খেতে দিত কিন্তু কতদিন। একদিন মামার বাড়ি থেকে রাস্তা দিয়ে আসার সময় দিনে দুপুরে দেখতে পেয়েছি মানুষের মরা লাশ পচা দুর্গন্ধ দিনের বেলায় শিয়াল-কুকুরের মরা লাশ তুলে টানা হেচরা করে খাচ্ছিল। মা এসব দেখে সড়ক দিয়ে হাঁটতে পারছিল না পড়ে গেল মাকে মামা টেনে তুলল বলল চলো আমরা আবার ফিরে যাই গ্রামে তোমার ছেলে এসব দেখলে পাগল হয়ে যাবে। মামা আমাদেরকে অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল তার বাসায়। পরের দিন সকালে শহর থেকে খবর গেল আজকে নাকি পশ্চিমা মেলেটারি  গ্রামে ঢুকে আক্রমণ করবে। এখন গ্রাম থেকে শুরু হলো আরো অনেক দূরের গ্রামের ফালানোর পালা সারি বেঁধে সবাই পালাতে শুরু করলো ঘর নেই বাড়ি নেই মানুষ যেখানে খুশি সেখানে ঘুমিয়ে পড়তো কেউ গাছ তলায় কেউ মানুষের বাড়ির আঙ্গিনায় কেউ আবার নদীর চরে তাবু দেঙ্গে। এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন রাতের পরে রাত মাসের পর মাস। তখন অনেক মানুষ না কেউ মারা গেছে। চাল আছে তো তরকারি নেই তরকারি আছে তো লবণ নেই মরিস নেই তেল লবন ছাড়া কোনরকম ভাত রান্না করে লবণ ছাড়া পেটের খুদায় মানুষ তাই খেত অনেকেই লবন ছাড়া খাবার খেয়ে ডায়রিয়াতে মারা গেছেন। এভাবে যুদ্ধ চলছিল প্রায় ১১  মাস।  হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম পাকিস্তানি বাহিনী মিলিটারি রা পরাজিত হয়েছে অনেক পাকিস্তানি মিলিটারি মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে সেলেন্ডার করেছে। একথা শুনে সবারই মনে বড় নিশ্বাস  ফেলে বলেন আল্লাহতালা এতদিন পর আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছে তার কাছে লাখো লাখো শুকরিয়া। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর তার নেতৃত্বে এই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুক্তি পেয়েছিল। সবাই বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করছে  আর যারা শরণার্থী হয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গিয়েছিলেন তারা পরে এসেছে।  ওই মুহূর্তে কেউ সজন কে হারিয়ে কান্না করছিল কেউ স্বাধীনতার কথ ভেবে আনন্দ করছিল। কিন্তু ওই মুহূর্তে কারো বাড়িতে খাবার ছিল না। ছিল শুধু স্বাধীনতার আনন্দ। বাবা বাড়িতে এসে দেখে কিছুই নেই সব লুটপাট হয়ে গেছে বাবার হাতে যা টাকাপয়সা ছিল সেগুলো শেষের দিকে। আবার কারো টাকা আছে এলাকাজুড়ে খাবার নেই বাবা বাড়িতে পুড়ে  যাওয়া টিন দিয়ে  একটা শাপরা তৈরি করলো। সেখানে আমাদেরকে রেখে চলে গেল খাবার আনার উদ্দেশ্যে কোত্থেকে জানি কিছু চাল আর কিছু ডাল নিয়ে এলো লবন মরিচ তেল কিছুই নেই ওভাবেই সিদ্ধ করে রাতে আমরা খেতে বসলাম। হঠাৎ করে একটি মাইকিং শোনা গেল পঞ্চগড় থানার মাঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে সবাইকে রিলিফ দেওয়া হবে। একথা শুনে অনেকেরই মনে একটু সান্তনা পেল। রাত তখন ৯ নয়টা সময় মাইকের শুনতে পাচ্ছি জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি বাবা হেসে হেসে বলে  এখন থেকে তোমাদের ইস্কুলে এই জাতীয় সংগীত গাইতে হবে। আমি তখন বললাম বাবা আমাদের জাতীয় সংগীত তো  ছিল অন্য, পাকিস্তান জিন্দাবাদ পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ পূর্বো বাংলার সেই মলীময়। বাবা তখন বলল এখন আর ওই জাতীয় সংগীত চলবে না। আমরা খুশিতে সকলেই পরের দিন সকাল বেলা আমার সোনার বাংলা গান মাইকের শুনি অনেকটাই শিখে ফেললাম। বন্ধুরা মিলে খেলতে শুরু করলাম যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা কেউ পাকিস্তানি মিলিটারি কেউ বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু যারা যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে গিয়েছে বাড়িঘর হারিয়েছে হারিয়েছে আত্মীয়-স্বজন তাদের মধ্যে অনেকেই আজ পর্যন্ত সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে নাই তাদের মধ্যে আমরা একজন। আবার অনেকেই তখন যারা বাদাম বিক্রি করতো তারা দেশ স্বাধীনের বছর দশেক পরে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।। এই ছিল আমার মুক্তিযুদ্ধের স্বচক্ষে দেখা এবং বলা। সব কথা মনে নেই অনেক ছোটবেলার কথা তো যতটুকু মনে পড়ছে ততটুকুই লিখলাম ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *